আমি আপনাকে ভালবাসি …………..জামশেদ শামীম

0
1234
ছবি: সংগৃহীত।

-প্রেম করেন?
রানীর কাছ থেকে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল অনি । চায়ে চুমুক না দিয়েই কাপটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে তাকাল রানীর দিকে । কি বলবে তার এই ছোট ও কঠিন প্রশ্নের উত্তরে বা কি বলা উচিৎ এই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায় । অনেক সময় অনেক ভাবেই প্রেম এসেছে, সঠিক নারীর সন্ধানে অনেক ভুল নারী এসেছে তার এই ছোট জীবনে । সবই কি তার প্রেম ছিল ? নাকি সত্য প্রেমের বিবেচনা ? অনির নীরবতা ভেঙ্গে রানী বলে ওঠে-“কিছু বলছেন না যে? নাকি প্রেমিকাদের সংখ্যা মনে করতে পারছেন না? এখন-তো অনেকেই এক সাথে অনেক গুলো প্রেম করে । যদিও আপনি সেই দলের না তা জানি” । “ফেসবুকে আমার যে লেখাটা দিয়ে আপনার সাথে আমার পরিচয় তাতে তেমন টা ভাবাই স্বাভাবিক”- কথাটা বলে একটু হেঁসে অনি একটা সিগারেট জ্বালাল। “হুম, প্রেমহীন জীবন বিষাদময়-বৈরাগ্য বাসা বাঁধে । আচ্ছা সত্যি কি প্রেম ছাড়া মানুষের জীবন বৈরাগীদের মতো হয়ে যায়?”- রানীর এমন প্রশ্নে সিগারেটে টান দিতেদিতে অনি বলতে থাকে “জীবনকে জানতে হলে মানুষের একবার হলেও প্রেমে পড়া বা প্রেম করাটা জরুরী । স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে মুখোমুখি দাড় করায় প্রেম । তবে আমার মতো বারবার ভুল মানুষের প্রেমে পড়লে জীবনের কোন এক সময় এই প্রেমকে শুধু মাত্র দুটি অক্ষরই মনে হবে । আর প্রেম যে শুধু দুটি মানুষের ভীতরে ঘটবে ঠিক তা নয়, প্রকৃতির সাথে, কাজের সাথে এমনকি ভিন্ন কোন সম্পর্কের মানুষের সাথেও হতে পারে । তবে একেকটি প্রেম একেক করম, একেক নামের ও ভিন্ন ভিন্ন অনুভুতি”। প্রেম নিয়ে এমনই এক তালগোল পাকানো আলোচনা দিয়েই পরিচয়ের প্রথম সন্ধ্যাটা পার হয়ে যায় অনি ও রানীর । দুজনের পরিচয় ফেসবুকে আর আজই প্রথম দেখা । এখন রাত আঁটটা ত্রিশ মিনিট, ঢাকা শহরে মাত্র সন্ধেই নামলো । সবে আড্ডা জমতে শুরু করেছে সব টং- দোকানে । রানীর বাসা থেকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছে কারন তার বাসায় ফিরতে আর কতক্ষণ লাগবে, তা জানার জন্য । অনি আর কথা না বাড়িয়ে রানীকে রিক্সায় তুলে দিল । “আপনি বাসায় ফিরবেন কখন? রাতে কি ফোনটা খোলা পাব”? রিক্সার হুড তুলতে-তুলতে জানতে চাইল রানী । রানীর প্রশ্ন দুটোর উত্তরে শুধুমাত্র “হুম” বলেই অনি হাঁটতে থাকে সেই টং- দোকানের দিকে । একে একে আসতে থাকে আড্ডার সব বন্ধু, বড় ভাই, ছোট ভাই ইটিভি-গলির এই আড্ডা চলে রাত দশটা পর্যন্ত এরপর মগবাজার মুক্তিযুদ্ধ গলিতে একটু আড্ডা দিয়ে বাসায় আসতে আসতে রাত বারটা । চিলেকোঠা ঘরের দরজা খোলার আগে ছাদের ঠাণ্ডা বাতাসে নিজেকে একটু শান্ত করে অনি । রান্না সে নিজেই করে আর কোন কারনে মন খারাপ থাকলে বা রান্না করতে ইচ্ছে না করলে; পানি আর সিগারেট দিয়েই রাত পার করে দেয় । আজ মনটা ভালো তবু কেন জানি তার রান্না করতে ইচ্ছে করছে না । উত্তর পাশের জানালায় দাড়িয়ে হাতিরঝিলের লাইটগুলোর দিকে অকারনে তাকিয়ে আছে । এমন সময় মৃদু শব্দে বেজে ওঠে তার সেল ফোনটি । রানীর ফোন, রিসিভ করতেই রানী বলে উঠলো-
…“কখন এলেন? ডিনার করেছেন ?”
…“এইতো বেশ কিছুক্ষণ ।”
…“বউতো নেই, বুয়া রান্না করে দিয়ে যায়? ”
…“বউ কি থাকার কথা ছিল? রান্না আমি নিজেই করি ।”
…“সত্যি? এই কথা আবার বউকে বলতে যাবেননা যেন, তাহলে সারা জীবন আপনাকে রান্নাই করতে হবে। অভিনয়, লেখালেখি সব চুলর ভীতর যাবে। তো, কি রান্না করলেন আজ ?”
…“ইচ্ছে করছে না আজ ।”
…“মানে কি? বাহির থেকে খেয়ে এসেছেন?”
অনি প্রসঙ্গটা অন্য দিকে নিয়ে গেল-
…“কাল বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃতি করতে হবে, সকালেই বেরবো। আপনার কি প্লান কাল ?”
…“কোন প্লান নেই, যদি কেউ একটু দয়া করে সাথে নেয় তাহলে বেরবো । কিন্তু সবাইতো শাড়ি পরে বেরবে, আমিতো শাড়ি পরতে পারিনা । তবে কেউ যদি কথা দেয় যে নিয়ে যাবে, তাহলে মাকে বলবো, মা পরিয়ে দেবে ।”
…“আচ্ছা কথা দিলাম ।”
…“তাহলে সকালে কোথায় দেখা হবে?”
…“বাংলা মোটর।”
দু’জনেই বিদায় নিয়ে ফোন রাখল । অনি একটি সিগারেট জ্বালিয়ে কাল সকালে যে কবিতাটি আবৃতি করবে তা একবার নিজে-নিজে আবৃতি করলো । আর কিছুক্ষণ জেগে থাকলেই পেটের রাক্ষসটি জেগে যাবে তাই অনি দ্রুত সিগারেটটা শের করে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ল ।

পরদিন সকালে কবিতা আবৃতি শেষ করে বাংলা মোটর পুলিশ বক্সের পাশে একটি লাল-সাদা পাঞ্জাবী পরে দাড়িয়ে আছে অনি । “শাড়িতে কেমন লাগছে আমাকে?” রানীর কণ্ঠ শুনে পিছনে ঘুরে তাকাল অনি । শাড়িতে যে কোন মেয়েকেই সুন্দরী লাগে, তবে রানীকে লাগছে অদ্ভুদ রকমের মায়াবতি । সাদা শাড়ি লাল পাড়, কপালে লাল টিপ, চোখে কাজল আর খোঁপায় বেলি ফুলের মালা সত্যি অদ্ভুদ সুন্দর লাগছে রানীকে । বোকার মতো তাকিয়ে আছে অনি । “থাক আর তাকিয়ে থাকতে হবেনা, এবার চলেন ।” রানীর কথায় একটু লজ্জাই পেল অনি । দুজনে হাঁটছে শাহাবাগের দিকে । রাস্তায় মানুষের ঢল, লাল-সাদা পোশাকে সবাই এসেছে বর্ষবরণ করতে । রানী হাঁটতে হাঁটতে এক সময় অনির হাত ধরে হাঁটতে থাকে । একি মানুষের স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নাকি সত্যি রানী তার হাতটি ধরে রাখতে চায় সারা জীবন, বঝেনা অনি । শাহাবাগ মোড় পার হয়ে অনি ভাবে একটু সামনে যেয়ে সে রানীকে কাঁচের চুড়ি কিনে দিবে । “এতো মানুষের মধ্যেও কেন জানি চিৎকার করে আপনাকে ভালোবাসি বলতে ইচ্ছা করছে।” কথাটি শুনে রানীর হাতাকে নিজের হাতের মধ্যে আরও শক্ত করে চেপে ধরে অনি, আর কথাটি বলে চোখে মুখে বেশ সাহস ও লজ্জা নিয়ে রানী তাকায় অনির দিকে। আচমকা দুটি কুকুর দ্রুত বেগে ছুটে যার অনি ও রানীর মাঝ দিয়ে । দুজনের হাত ছুটে যায় । অনি কিছু বলার আগেই আরও পাঁচসাতটা কুকুর এসে ঘিরে ধরে তাকে, একের পর এক কামড় বসাতে থাকে তার গায়ে আর তার চোখের সামনেই আরও পাঁচসাতটা কুকুর খুলে নেয় রানীর শাড়ি, নখ বসিয়ে দেয় রানীর বুকে । অসহায় অনি, অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই এই এক ঝাক কুকুর থেকে বাঁচাতে পারেনা রানীকে । তাদের চিৎকারে কিছু মানুষ থামে তবে কেউ কুকুর তাড়ায় না । পকেট থেকে স্মার্ট ফোন বের করে সেই সব স্মার্ট মানুষেরা ছবি তোলে বিবস্ত্র রানীর, ছুটে আসে সাংবাদিকদের ক্যামেরা, স্মার্ট মানুষদের মাঝে মিশে যায় কুকুরগুলো । সাথেসাথেই অনেক স্মার্ট মানুষ তাদের স্মার্ট ফোন দিয়ে ফেসবুকে আপলোড দেয় রানীর বিবস্ত্র ছবি আর ক্যাপশনে কুকুর গুলকে গালি । চার পাশে কাকেরা ঘৃণায় কা-কা করে চিৎকার করে ওঠে ।

নিজের পাঞ্জাবীতে রানীকে ঢেকে দেয় অনি । এই স্মার্ট মানুষদের ডাস্টবিন থেকে একটি পাথরের মূর্তির মতো রানীকে বুকে চেপে নিয়ে চলে যায় অনি । এরপর থেকে রানী আর কথা বলেনি, সত্যি সে পাথরের মূর্তি হয়ে যায় । চিৎকার করে আর রানীর বলা হয়নি- “অনি, আমি আপনাকে ভালোবাসি ।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here