চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
মহুয়া বাংলার অলিখিত সাহিত্যের জনপ্রিয় আখ্যান কাব্যপালা। দ্বিজ কানাই প্রণীত এই কাব্যে আবহমান বাংলার অকৃত্রিম ছবি উঠে এসেছে অপূর্ব বাণীবিন্যাসে। মানবমনের চিরকালীন প্রেমাকাক্সক্ষাই এর প্রধান উপজীব্য। জাতপাতের উর্ধ্বে মানবিক সম্পর্কে মহত্বই এতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সমগ্র ময়মনসিংহ গীতিকায় মহুয়া পালা সবচেয়ে রোমান্টিক, একই সাথে বিষাদময় আখ্যানও বটে। পশ্বিমবাহিত সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং পথিবীতে অভিন্ন-গ্রাম নির্মাণের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প যখন আমাদের আত্মপরিচয়ের চিহ্ন সূত্রসমূহ গ্রাস করতে উদ্যত, তখন লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ভুবনে বিচরণ আমাদের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখনই আমরা নির্ভর করতে বাধ্য হই আবহমান বাংলার অকৃত্রিম লোক উৎস ময়মনসিংহ গীতিকার প্রশস্ত প্রান্তরে।
ময়মনসিংহ গীতিকার এই আসাধারণ আখ্যান অবলম্বনে ‘প্রমা’র পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা ‘মহুয়া’র পঞ্চম মঞ্চায়ন হয়ে গেল গতকাল সন্ধ্যে সাতটায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। ‘মহুয়া’র শুরুতেই তবলা ও হারমোনিয়ামের সাথে বাঁশির করুণ সুরে বোঝা গেল বিরহের কাহিনীই আজ প্রদর্শন করবেন শিল্পীরা। মঞ্চায়নের পর সে ধারণাই সত্যি হলো। জমিদারপুত্র নদীর চাঁদ আর হুমরাবেদের পালিত কন্যা মহুয়ার হৃদয়ের আকুল আর্তি ছড়িয়ে ছিল কাব্যের প্রতিটি পঙতিতে। প্রেমময় এই আখ্যানে সর্বংসহা বাঙালির নারীর চিরকালীন প্রেমচেতনা, প্রত্যাশা, হতাশা, না-পাওয়ার যন্ত্রণা অসাধারণ শিল্পকুশলতায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রেমাস্পদের সাথে মিলিত হওয়ার আকাঙ্খা মানব-মানবীর চিরন্তর বাস্তবতা মহুয়াতের প্রতিফলিত হয়েছে। প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষনে নদের চাঁদ ছুটে গিয়েছিল মহুয়ার সান্নিধ্যে। কিন্তু অজস্র প্রতিকুলতা যখন উভয়ের মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে জয়ী করে প্রেমকে। সমগ্র ময়মনসিংহ গীতিকায় মহুয়া পালা সবচেয়ে রোমান্টিক ও একই সাথে বিষাদময় কাহিনী।
প্রমা-আবৃত্তি সংগঠন ‘মহুয়া’র প্রথম প্রদর্শনী করেছিল ভারতের আগরতলায় ২০১৫ সালের ১ নভেম্বরে। একই বছরের ৬ নভেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমি চট্টগ্রামের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মহুয়া’র দ্বিতীয় প্রদর্শন এবং ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট চতুর্থ প্রদর্শনী হয়েছিল ভারতের কলকাতায়। শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে গতকালের প্রদর্শনীর শুরুতেই অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কবি ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী ও কামরুল হাসান বাদল ।
এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রমা’র সভাপতি আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসান। মহুয়া’র নির্দেশনায় ছিলেন প্রমার সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পাল ও গ্রন্থনা করেছেন মঞ্জুর মুন্না। প্রযোজনা ভাবনায় ছিলেন বাপ্পা চৌধুরী ও কংকন দাশ। এতে মহুয়া চরিত্রে কাজ করেছেন তাসলিমা আক্তার বৃষ্টি এবং নদের চাঁদ চরিত্রে কাজ করেছেন মঞ্জুর মুন্না। অন্যান্য চরিত্রে অংশগ্রহণ করেছেন বিশ্বজিৎ পাল, জেরিন মিলি, রোজী বিশ্বাস, রাজু দাশগুপ্ত, মাহফুজ আহমেদ, আচরারুল হক, লিটন নন্দী, আবুল ফয়েজ, পার্থ প্রতিম মহাজন, হৈমন্তী শুক্লা মল্লিক, কলি দাশ, সালমা জাহান, তপতী মজুমদার, জয়ন্ত বসুৃ, চৈতী কুৃন্ডুৃ ও প্রতিমা দাশ, সৈয়দা হুৃজ্জাতুৃন নূর আকা। বাঁশিতে ছিলেন বিকাশ নন্দী নিউটন, তবলায় ছিলেন রানা বড়ুয়া এবং কী-বোডে’ ছিলেন সৃজন রায়।