২০১৮ সাল যেন ছিলো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সৃত্মির পাতায় অবিচ্ছেদ্দ এক অংশ। এ বছরে সংগীত শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, নাট্যাকার ও অভিনয় শিল্পীরা না ফেরার দেশে পারি জমান। এদের মধ্যে কিংবদন্তীর মৃত্যুতে শোবিজে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তাদের মৃত্যুতে শোবিজের পাশাপাশি ভক্তদের মনে দাগ কেটে গেছে।
“চলে গেলেন যারা না ফেরার দেশে” নিয়ে লিখেছেন- এস.এ.এম সুমন
কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চু
বাংলাদেশের কিংবদন্তি ব্যান্ড সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু গত ১৮ অক্টোবর ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি নিজ বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে পরে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, প্লে-ব্যাক শিল্পী। এলআরবি (লাভ রানস ব্লাইন্ড) ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ও ভোকাল আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন।
সিরাজ হায়দার
বিশিষ্ট অভিনেতা সিরাজ হায়দার মারা গেছেন বছরের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে রাজধানীর কল্যাণপুরে নিজ বাসায় হার্ট অ্যাটাক করে তিনি মারা যান।
সিরাজ হায়দার অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘ ৫৫ বছরেরও বেশী সময় ধরে। ১৯৬২ সালে নবম শ্রেণীর ছাত্রকালীন সময়ে ১৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দিবসে টিপু সুলতান নাটকে করিম শাহ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি অভিনয় করেছেন যাত্রা, মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে।
আমজাদ হোসেন
অভিনয়শিল্পী ও বরেণ্য পরিচালক আমজাদ হোসেন ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে মারা যান। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
পরিচালক আমজাদ হোসেনের জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি।
গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
সাইদুল আনাম টুটুল
বরেণ্য নির্মাতা ও সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল নভেম্বরের ১৮ তারিখে মারা যান। হার্ট এ্যাটাক করলে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সাইদুল আনাম টুটুলের বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
সরকারি অনুদানে নির্মিত সাইদুল আনাম টুটুল নির্দেশিত প্রথম সিনেমা ছিল ‘আধিয়ার’ সিনেমাটি ২০০১ সালে মুক্তি পেয়েছিল। তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘কালবেলা’র কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বলতে গেলে শেষ লটের কাজ করার আগেই সাইদুল আনাম টুটুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে মৃত্যুর অসহায়ত্বের কাছে হার মানেন তিনি।
শাম্মী আক্তার
বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আক্তার মারা গেছেন বছরেরে ১৬ জানুয়ারি তারিখে মঙ্গলবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে শাম্মী আক্তার ক্যান্সারে ভুগছিল। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’, ‘আমি যেমন আছি তেমন রব বউ হবো না রে’, ‘ভালোবাসলেও সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’- এমন অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী শাম্মী আক্তার। সংগীত জীবনে অসংখ্য পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।
রানী সরকার
ঢাকাই চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত অভিনেত্রী রানী সরকার অধ্যায়ের অবসান ঘটে ৭ই জুলাই। বার্ধক্যজনিত কারণে মতিঝিলের একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। নব্বই দশকে আর্থিক সংকটের ফলে তিনি লোক চক্ষুর আড়াল হন।
২০১৪ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রী পঞ্চাশের দশক থেকে বড় পর্দায় অভিনয় শুরু করেন। ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিষেক হয় এ অভিনেত্রীর। তার অন্যান্য অভিনীত সিনেমা চান্দা, তালাশ, বন্ধন, সঙ্গম, ইম ধরতি পার, আজান, কাঁচের দেয়াল, কাঁচ কাটা হীরে, বেহুলা, আনোয়ারা, ছদ্মবেশী, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, তিতাস একটি নদীর নাম, চন্দ্রনাথ, শুভদা, দেবদাস, আয়না, থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার, প্রভৃতি।
আলী আকবর রুপু
বরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলী আকবর রুপু ২২ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তার মৃত্যু হয়। প্রায় আড়াই বছর ধরে হৃদরোগে ভুগছিল আলী আকবর রুপু।
১৯৮০ সালে ‘একটি দুর্ঘটনা’ অ্যালবাম দিয়ে অডিও গানে তার অভিষেক ঘটে।
আলী আকবর রুপুর সুর ও সংগীত পরিচালনায় অসংখ্য গান জনপ্রিয় হয়েছে। গানের তালিকায় রয়েছে সাবিনা ইয়াসমিনের ‘প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি’, এন্ড্রু কিশোরের ‘পদ্ম পাতার পানি নয়’, মুরাদের ‘আমি আগের ঠিকানায় আছি’, কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘একদিন কান্নার রোল পড়বে আমার বাড়িতে’, ‘যারে ঘর দিলা সংসার দিলা রে’, ‘দস্যু যেমন মুখোশ পরে প্রবেশ করে ঘরে’, ‘দরদিয়া’, ‘এ অনিশ্চয়তা’, ‘এ পশলা বৃষ্টি’, শাকিলা শর্মার ‘তোমাকে দেখলেই মৌনতা ভুলে যাই’, সাবিনা ইয়াসমিন, কনক চাঁপা ও সামিনা চৌধুরীর ‘সব চাওয়া কাছে পাওয়া’, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘কবিতার মতো মেয়েটি, গল্পের মতো ছেলেটি’, সামিনা চৌধুরীর ‘জানতে চেয়ো না কোন সে বেদনাতে’, দিনাত জাহান মুন্নীর ‘পুরোনো কাপড়ের মতো আমি আজ অবহেলিত’, মৌটুসীর ‘বারে বারে পোড়া বাঁশি এত রাতে আর ডেকো না’ ইত্যাদি।
কাজী আজিজ আহমেদ
প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার, চিত্রপরিচালক ও গীতিকার কাজী আজিজ আহমেদ ৩০ জানুয়ারি ভোরে শেরপুরে বড় মেয়ে কাজী বন্যা আহমেদ এর বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮০ বছর।
‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে’ – ইত্যাদি গানের জন্য বিখ্যাত হলেও তিনি ‘খান আতা’র ‘অনেক দিনের চেনা’ এর সহকারী হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করে পরবর্তীতে কাহিনীকার, সংলাপকার, চিত্রনাট্যকার এবং চিত্রপরিচালনা করেছেন। উলঝান, যে আগুনে পুড়ি, ক খ গ ঘ ঙ, এরাও মানুষ, ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, গুনাই বিবি, অনন্ত প্রেম, বাজিমাত ইত্যাদি সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি।
চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন ডিসেম্বর ১ তারিখে মৃত্যু বরন করেন। রাজধানীর পান্থপথের একটি হোটেলের কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ সিনেমার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের তার অভিষেক হয়। ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ ছাড়াও আনোয়ার হোসেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’,‘পুরস্কার’, ‘অন্য জীবন’ এবং ‘লালসালু’র জন্য শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
মঞ্জুর হোসেন
চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান অভিনেতা মঞ্জুর হোসেন ডিসেম্বর ৭ তারিখে বনানীতে তিনি নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
মঞ্জুর হোসেন জন্ম ১৯৩৭ সালে। তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনাও করেছেন। তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘রাজধানীর বুকে’। এরপর তিনি ‘হারানো দিন’, ‘ধারাপাত’, ‘সাত রং’, ‘তালাশ’, ‘শীত বিকেল’, ‘বন্ধন’, ‘মিলন’, ‘কাজল’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘কাঞ্চন মালা’, ‘ছোট ‘নয়ন তারা’, ‘তুম মেরে হো’, ‘কুলি’, ‘রূপবান’সহ অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন।