
বাংলাদেশের অসম্ভব জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রী রোজিনা। রোজিনার পারিবারিক নাম রওশন আরা রেনু । কিন্তু সিনেমা করতে এসে সেই নাম পাল্টে হয়ে গেলেন রোজিনা। ১৯৭৬ সালে নিজের নামের এই পরিবর্তন ঘটালেন। কিন্তু যে ছবির জন্য তার এই নামের ঝলক যে ছবির জন্য নাম পরিবর্তন করে রোজিনা সেই ছবি তার আর করা হয়নি। এরমাঝে আরো একটি ছবিতে তিনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, হঠাৎ ওই সময় অসুস্থ হয়ে গেলে পরিচালক অন্য একজন নায়িকাকে নিয়ে ফেললে রোজিনা ভিষণ কষ্ট পান। এরপর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যেভাবেই হোক চলচ্চিত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করবেন। এই প্রতিকুল সময়ের বিপরীতে কিভাবে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সেটি তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক।
‘ছোটবেলা থেকেই সিনেমায় কাজ করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। একবার সংসদ ভবন এলাকায় একটা ছবির শ্যুটিং হচ্ছিল আমি সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। ওই সময় ড্রিংকস পরিবেশনের জন্য একজনের প্রয়োজন পড়ে। তখন আমি আগ্রহ প্রকাশ করি। তারপর আমি ড্রেস চেঞ্জ করে কয়েকটি শট দেই। এটাই প্রথম। এরপর নিজের স্বপ্ন আরো বেড়ে গেল। অনেকের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো। কিন্তু কেউ কাজ দিতে চায় না। তারপর একটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হই কিন্তু পরবর্তীতে সেই ছবিতে আর কাজ করা হয়নি।’
চলচ্চিত্রের দীর্ঘ পথ:
চলচ্চিত্রের দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দেওয়া তার জন্য ততটা সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল তার ভিষণ আগ্রহ। সেই আগ্রহই তাকে খ্যাতির এই চূড়ায় নিয়ে এসেছে। তার শুরুটা ছিল খুবই ছোট একটি কাজ দিয়ে। মাত্র কয়েকটি শট। এই কয়েকটি শটই তার জীবনের গতিধারা পাল্টে দেয়। স্বপ্ন দেখতে থাকেন বড় মাপের একজন অভিনেত্রী হওয়ার। বুনতে লাগলেন কিভাবে এই জগতে নিজের জায়গাটি তৈরি করবেন। কিন্তু শুরুতে কেউই তাকে সে সুযোগ দিতে চায়নি।
এ সম্পর্কে রোজিনা বলেন, ‘নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ শুরু করি। চেষ্টা করতে থাকি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। সর্বোচ্চ দিয়ে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করতে থাকি। এরপর ১৯৭৭ সালে এফ কবীর চৌধুরীর ‘রাজমহল’ ছবিতে চিত্রনায়ক ওয়াসিমের বিপরীতে অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসা পাই। তারপর একে একে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করি। আমজাদ ভাই এর ‘কসাই’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। তারপর শুধু বাংলাদেশ নয়- নেপাল, পাকিস্তান, ভারত এসব দেশের ছবিতেও অভিনয় করি।’
রোজিনার ছবি মানেই হিট:
ব্যর্থতার মাধ্যমে পথ চলা শুরু করলেও পরবর্তীতে রোজিনা একের পর এক সুপার-ডুপার হিট ছবি উপহার দেন। যারাই তাকে শুরুর দিকে অবজ্ঞা করেছেন, সুযোগ দিতে চাননি। তারাই পরবর্তীতে তাকে পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকতেন। ‘কসাই’ চলচ্চিত্রের পর মতিন রহমান পরিচালিত ‘জীবনধারা’ ছবির জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে আবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর কবীর আনোয়ার পরিচালিত ‘দিনকাল’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্যও পুরস্কৃত হন।
দেশের বাইরের ছবি:
খ্যাতিমান এই অভিনেত্রী ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘হাম সে হায় জামানা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ওই ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক নাদিম। তার আগে ১৯৮৪ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘অবিচার’ এ মিঠুন চক্রবর্তীর বিপরীতে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বিভিন্ন ছবিতে রোজিনার লুপে গাওয়া গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘এই মন তোমাকে দিলাম, তুমি চোখের আড়াল হও, কাছে কি বা দূরে রও’ ‘ছেড়ো না ছেড়ো না হাত’ ‘তুমি আমার কত চেনা’ এ ধরনের অসংখ্যা কালজয়ী গানের মাধ্যমে রোজিনা নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
সিনেমার বর্তমান ও অতীত:
এই সময়ের ছবি এবং তার আমলের ছবি নিয়ে কথা বলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। রোজিনা বলেন, ‘অসংখ্যা ছবিতে আমি অভিনয় করেছি। রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর সবার সঙ্গেই কাজ করা হয়েছে। আমাদের সময় চলচ্চিত্রের গানগুলো ছিল অনেক মেলোডি নির্ভর যা এখনকার ছবিতে খুব একটা দেখা যায় না। ভালোবাসা নির্ভর ছবি এখন কম। আমাদের সময় গল্প, গান, চিত্রনাট্য সব কিছু নিয়েই ভালো করার একটা চেষ্টা ছিল। আমরাও চেষ্টা করতাম সর্বোচ্চটা দেওয়ার। কিন্তু এখন সবাই টাকার পেছনে দৌঁড়াতে চায়। ফলে কেউ আর ভালো অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে উঠছে না।’
বধূবেশে রোজিনা:
তখন তিনি ৬৬র জাতিকা। তারপরেও অম্লান তার গ্লামার। গত ২০২১ সালে লাল রঙের লেহেঙ্গায় নব বধূবেশে ক্যামেরাবন্দি হন এই কিংবদন্তি। ভিডিওতে দেখা যায় বধুবেশে এক যুবতীকে। সামাজিক মাধ্যমে ভেসে বেড়ানো ছবিটি হয় ভাইরাল। প্রশ্ন ওঠে নব বধূবেশে এই যুবতী কে?
তবে একটু চোখ মেলে তাকালেই বোঝা যায়, এই রমনী কোনও যুবতী নন, আশির দশকের ঢাকাই সিনেমার দর্শকপ্রিয় নায়িকা রোজিনা। ৬৬ বছর বয়েস বধূ সেজে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
যদিও তার এই সাজ কোনো নাটক বা সিনেমার জন্য নয় ,এমন সাজ একটি ফটোশুটের জন্য এমন মোহনীয় রূপে ক্যামেরাবন্দি হন কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী। রোজিনার ভাষ্য, ‘নতুন রূপে নিজেকে দেখে খুব ভালো লাগছে। কতটা ভালো লাগছে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মনে হচ্ছে, আমি সেই আশির দশকে চলে গিয়েছি।
সিনেমায় যাত্রা শুরু :
বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ লিখেছিলেন, আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার/তোমারে করি নমস্কার/এখন বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর–তোমারে করি নমস্কার… ১৯৭৬ সালে ‘জানোয়ার’ চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে নাম লেখান রোজিনা। এফ কবীর পরিচালিত ‘রাজমহল’ সিনেমায় নায়িকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তবে ওপার বাংলা তথা বলিউডের সেরা ড্যাশিং হিরো মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে তারা স্কিন শেয়ার ছিল তার অভিনয় প্রদর্শের বড় প্লাট ফর্ম। শক্তি সামন্তর মতো স্বীকৃত পরিচালকের ছবিতে তিনি কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করেন। ছবিতে তার বিপরীতে কেবল মিঠুনই নন ছিলেন সেরা কয়েকজন। যাদের ভিতরে গোলাম মোস্তফা, এটিএম শামসুজ্জামান, নূূূতন ,অমল বোস, সৈয়দ হাসান ইমাম আহমেদ শরীফ একই সঙ্গে ভারতের উৎপল দত্ত,অসিত সেন ও মানিক দত্ত। ছবির সমস্ত গানের কথা রচনা করেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সংগীত পরিচালনা করেন আরডি বর্মণ।
গানগুলো হচ্ছে, ‘ছেড়ো না ছেড়ো না হাত ’- (কিশোর কুমার, সাবিনাইয়াসমিন)
‘দেখলে কেমন তুমি খেল ’- (কিশোর কুমার)
‘মন-মাঝি রে’ – (আর ডি বার্মান)
‘নাগর আমর কাঁচা পীরিত ’- (আশা ভোঁসলে, শৈলেন্দ্র সিং)
‘রুই কাৎলা ইলিশ ভেবে’ – (সাবিনা ইয়াসমিন)
‘রুই কাৎলা ইলিশ তো নয়’ – (কিশোর কুমার)
ছবির গানগুলো তখনকার সময় থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
কাজের স্বীকৃতি:
মানুষের ভালবাসাই হচ্ছে একজন অভিনয় শিল্পীর সেরা পুরস্কার। সে কাজটি তিনি নিজের অভিনয়
দক্ষতা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই অর্জণ করেছেন। এরপর এসেছে বিভিন্ন সংগঠন সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া স্বীকৃতির পালা। তাই তো তার ঝুলিতে উঠেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। সর্ব শেষ গত ১৪ই নভেম্বর ২৩ মঙ্গলবার ওরা ১১ জন’ খ্যাত অভিনেতা খসরু ও রোজিনাকে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ২০২২ সালের আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছেন।
তার অভিনীত জনপ্রিয় সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘চোখের মণি’, ‘সুখের সংসার’, ‘সাহেব’, ‘তাসের ঘর’, ‘হাসু আমার হাসু’, ‘হিসাব চাই’, ‘বন্ধু আমার’, ‘কসাই’, ‘জীবনধারা’।
অভিনেত্রী থেকে পরিচালক: প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন রোজিনা। সিনেমাটির নাম ‘ফিরে দেখা’। সরকারি অনুদানের এ সিনেমায় অভিনয় করছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, নিরব ও অর্চিতা স্পশিয়াসহ অনেকে। অভিনয়ও করছেন রোজিনা নিজেও।
প্রবাসে অভিনেত্রী রোজিনা: কবরী উত্তর যুগে সিনেমার রাণী রোজিনা বর্তমানে লন্ডনেই বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন। ‘ক্ষতিপূরণ’, ‘ধনী গরীব’, ‘আনারকলি,’ ‘কসাই’, দোলনা, রুপবান, অবিচার, রাস্তার রাজা, মিস ললিতা, অভিযান, মানসীসহ প্রায় ২৫৫টি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। সর্বশেষ ২০০৫ সালে ‘রাক্ষসী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে এ জগত থেকে বিদায় নিয়েছিলেন এক সময়ের পর্দা কাঁপানো এই অভিনেত্রী বর্তমানে সিনেমা নির্মাণ নিয়ে কাজ করছেন। পরিচালনায় সিনেমার নাম ‘ফিরে দেখা’ বিগত ১৬ জুন ২০২৩ মুক্তি পেয়েছেন সিনেমাটি।
আপনার মতামত লিখুন :